কবি রাহুল চন্দ্র দাস : সাংখ্য দর্শনের পুরুষ ও প্রকৃতিকে ঘিরে লোক দর্শননের যে পথ সিন্ধু সভ্যতা পাড়ি দিচ্ছে সেই পথের বিবর্তন পরিবর্তনের ছাপ লেগে আছে আমাদের লোকায়ত দর্শনে।সাংখ্য দর্শনকে নাস্তিকের দর্শন বলে অবহিত করলেও কালের পরিক্রমায় সেই দর্শন মিশে গেছে সনাতনের রক্তে।তাই সনাতন নিজের সৃষ্টি ও বির্সজনকে আপন হাতে সাজাতে পারে;প্রকৃতিকে কেন্দ্র লোকায়ত ব্রত য্যানো তার প্রমাণ। প্রকৃতিতে চলছে বোরো ধানের মৌষম;কার্তিকের শুরুতে বীজতলা হতে ধানের চারা জমিতে রোপণের মাধ্যমে যার শুরু। জমিতে ধান রোপণের শুরু হয় ধন ও ধানের দেবী লক্ষ্মীকে কেন্দ্র করে। তাই তো ধান রোপণের শুরুতেই লক্ষ্মীকে স্মরণ করা হয়। প্রকৃতির হাত ধরে কার্তিক অগ্রহায়ণ পৌষ মাঘ ফাল্গুন শ্যাষে আসে চইত। চইতের শুরুতে ধানের চারার শরীর গর্ভবতী হয়। মা যেমন গর্ভমতী মেয়েকে সাধ ভোজনের মাধ্যমে নতুন অতিথিকে স্বাগত জানায় তেমনি পোয়াতি ধানের চারাকে স্বাগত জানানো হয় ক্ষীরবাসের মাধ্যমে। ক্ষীরবাস পোয়াতি ধানকে সাধ খাওয়ানোর লোকায়ত আচার। ক্ষীরবাসকে কেন্দ্র করে কৃষকের ঘর সাজে নানা আলপনায়। নানাবিধ ফলের সমারোহের পাশাপাশি লক্ষ্মীর জন্য রান্না করা হয় পাঁচ তরকারি। ফলমূল পাঁচ তরকারি দিয়ে লক্ষ্মীর নামান্তরে য্যানো প্রকৃতিকেই খুশি করা হয়। সেই খুশিতেই য্যানো প্রকৃতি ফসলের গানে তোলে নতুন সুর।যে সুরে হাওরে আসে সোনালি ধানের গান। হুন্দা (এক ধরনের গাছ) মেতি পুড়িয়ে তৈরি করা হয় কালো রঙ, সেই রঙে তেল মিশিয়ে টিকা দেওয়া হয় পোয়াতি ধানের চারায়।মা যেমন সাধের সময় মেয়েকে সাধ্যমতো দেয় নতুন শাড়ি গয়না তেমনি গর্ভবতী ধানের চারাকে কাপড়ের সুতা গয়নায় সাজানো হয়।বাঁশের কুলাতে সমস্ত ফল সাজিয়ে ফলের সাথে ক্ষীর মালপোয়া দুধ ঘি সিঁদুর সুতা জল নিয়ে উপবাস থেকে সকল কৃষাণী জমা হয় একটা নির্দিষ্ট স্থানে। সেখানে হতে সবাই চলে যায় নিজ নিজ জমিতে। যে জমিতে কার্তিকে প্রথম ধান চারা রোপণ হয় সেই জমিতেই দেওয়া হয় পোয়াতি ধানের ক্ষীরবাস। জমির চার কোণে জল দিয়ে ধানের চারাকে স্নান করানো শেষে কাপড়ে সুতা দিয়ে প্যাঁচানো হয় দেওয়া হয় সিঁদুর চন্দন হুন্দার টিকা। সেই সাথে পানের আগপাত সুপারি ও কুলায় সাজানি ভোগ সামগ্রী দিয়ে ধানের চারার সামনে ভোগ সাজানো হয়। ভূমি মাতার জরায়ুতে ফসল ফলাতে লাঙল দেয় পুরুষ ;সেই পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে পৃথিবীর বুকে আসে সৃষ্টির সোনালি ফসল।মূলত ক্ষীরবাসের সময় পোয়াতি ধানে থইর আসে। সেই থইর ধীরে ধীরে ধানের ছড়াতে পরিণত হয়। চইতের শ্যাষে ধানের ছড়া সবুজ হতে সোনালি হতে শুরু করে। সেই সাথে সবুজ ধানের ভেতর সাদা যে অংশ থাকে তা শক্ত হয়ে চাল হয়।কৃষাণি মনের আনন্দে গায়,
“মা লক্ষ্মীর বরে
ধান আইবো ঘরে। “
লোকায়ত এই ব্রতের দিকে বিঁদুর দৃষ্টিতে থাকালে আমরা বুঝতে পারি প্রকৃতি আর আমাদের জীবন যে এক সূত্রে গাঁথা। জীবনের তাগিদে প্রকৃতিকে আমরা করেছি আপন ;সেই আত্মসংশয় হতে নারী শক্তি কখনো লক্ষ্মী কখনো সরস্বতী কখনো কালি কখন দূর্গা হয়ে এসেছে আমাদের লোকায়ত জীবনে। পশ্চাৎ দর্শনের ভীড়ে আমাদের লোকায়ত দর্শন আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ;ক্ষমতায়নের ভূতে আমাদের গ্রাস করছে পশ্চিমা দর্শন অথচ চোখ খোললেই আমাদের লোকায়ত দর্শন আমাদের চোখে ধরা দেয় বাতিঘর হয়ে।